মস্তিষ্ক: মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও রহস্যময় অঙ্গ

মানুষের মস্তিষ্ক শুধু একটি অঙ্গ নয়; এটি প্রকৃতির একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি। আধুনিক সুপারকম্পিউটারের চেয়েও বেশি জটিল এই যন্ত্রটি আমাদের চিন্তা, আবেগ, স্মৃতি, এবং পরিচয়ের মূল কেন্দ্র। মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা আজও চলমান, আর প্রতিটি গবেষণা আমাদের এটির অতুলনীয় শক্তি ও জটিলতা দেখায়। আসুন, মস্তিষ্ক সম্পর্কিত কিছু বিস্ময়কর তথ্য বিজ্ঞান, বিশ্লেষণ ও গবেষণার আলোকে বিস্তারিতভাবে জানি।

শক্তির ব্যবহার: একটি অদক্ষ শক্তি-কেন্দ্রিক অঙ্গ

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ১.৪–১.৫ কেজি, যা শরীরের মোট ওজনের মাত্র ২% হলেও এটি আমাদের শক্তির ২০–২৫% ব্যবহার করে। প্রতি মিনিটে হৃদপিণ্ড থেকে পাম্প হওয়া রক্তের ১৫–২০% মস্তিষ্ক গ্রহণ করে এবং প্রায় ২০ ওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করে, যা এক একটি ক্ষীণতর LED বাতি জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট।

মস্তিষ্কের প্রধান শক্তি উৎস হল গ্লুকোজ, যা নিউরনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রেরণে ব্যবহৃত হয়। পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি (PET) এবং কার্যকরী চৌম্বকীয় অনুরণন ইমেজিং (fMRI) স্ক্যান দেখায় যে, যখন আমরা জটিল কাজ করি—যেমন গণিতের সমস্যা সমাধান বা নতুন ভাষা শেখা—মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট অংশে রক্তের প্রবাহ ও গ্লুকোজ ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি প্রমাণ করে যে মানসিক প্রচেষ্টা সরাসরি শক্তির খরচের সাথে সম্পর্কিত।

স্নায়ুকোষের জগৎ: একটি মহাজাগতিক নেটওয়ার্ক

মানব মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ (নিউরন) থাকে। প্রতিটি নিউরন গড়ে ১,০০০–১০,০০০টি সিন্যাপসের মাধ্যমে অন্যান্য নিউরনের সাথে সংযুক্ত থাকে। মোট সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন বা তারও বেশি, যা আমাদের ছায়াপথের তারার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

এই সংযোগগুলোই আমাদের চিন্তা, আবেগ, স্মৃতি এবং কগনিটিভ কার্যাবলির ভিত্তি তৈরি করে। স্নায়ুপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity) নামক বৈশিষ্ট্য আমাদের শেখার এবং নতুন অভিজ্ঞতা গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, এক গবেষণায় দেখা গেছে যে একজন বেহালাবাদক (Violinist)-এর মোটর কর্টেক্সের অংশ, যা বাম হাতের আঙ্গুলের জন্য দায়ী, সাধারণ ব্যক্তির তুলনায় অনেক ঘন। এটি প্রমাণ করে যে অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের কাঠামো শারীরিকভাবে পরিবর্তন করতে পারে।

তথ্য প্রক্রিয়াকরণ: একটি অতিমানবীয় সুপারকম্পিউটার

মস্তিষ্ক প্রতি সেকেন্ডে লাখ লাখ তথ্য বিট প্রক্রিয়া করতে সক্ষম। আমাদের চোখ, কান, নাক, ত্বক এবং জিহ্বা থেকে আসা সেনসরি তথ্য অবিরামভাবে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। শুধু চোখ থেকেই প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০ মিলিয়ন বিট তথ্য মস্তিষ্কে যায়, যেখানে সচেতন মন মাত্র ৪০–৫০ বিট প্রক্রিয়া করতে পারে।

মস্তিষ্ক এই তথ্যের স্রোত উচ্চ দক্ষতার ফিল্টারিং সিস্টেম ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করে। থ্যালামাস ও সেরিব্রাল কর্টেক্সের মতো অংশ অপ্রয়োজনীয় তথ্য ফিল্টার করে এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সচেতন মনোযোগে পৌঁছায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি শোরগোলপূর্ণ কক্ষে মস্তিষ্ক “ককটেল পার্টি ইফেক্ট” ব্যবহার করে কেবল আপনার মনোযোগের কথাগুলো স্পষ্টভাবে শোনায়।

নাজুক ভারসাম্য: ঘুম, পুষ্টি এবং আঘাতের প্রভাব

মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ঘুম, পুষ্টি এবং আঘাতের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

ঘুম: ঘুমের সময় মস্তিষ্কের “গ্লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম” বিপাকীয় বর্জ্য, যেমন অ্যামিলয়েড-বিটা প্রোটিন, পরিষ্কার করে। ঘুমহীনতা এক রাতেই এই বর্জ্যের স্তর বাড়িয়ে দিতে পারে, যা আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ায়।

পুষ্টি: নিউরনের ঝিল্লি ও নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করতে ওমেগা-৩, ভিটামিন বি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রয়োজন। অপুষ্টি বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে স্থায়ীভাবে জ্ঞানীয় বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

মাথায় আঘাত: ছোট আঘাতও “কনকাশন” সৃষ্টি করতে পারে, যা স্মৃতি, মনোযোগ ও সমন্বয় প্রভাবিত করে।

ব্যথাহীন অঙ্গ: স্নায়ুশল্য চিকিৎসার সুবিধা

মস্তিষ্ক নিজে ব্যথা অনুভব করতে পারে না, কারণ এতে নোসিসেপ্টর নেই। তাই অ্যাওয়েক ব্রেইন সার্জারি সম্ভব, যেখানে রোগী সম্পূর্ণ সচেতন থাকে।

শল্যচিকিৎসকরা মস্তিষ্কের টিউমার বা ইপিলেপসির উৎস সরানোর সময় রোগীকে কথা বলতে বা আঙ্গুল নাড়াতে বলেন। এতে তারা বাস্তব সময়ে ফাংশনাল ম্যাপ তৈরি করে এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশে ক্ষতি এড়াতে পারেন।

মস্তিষ্ক কেবল একটি অঙ্গ নয়; এটি চেতনা, পরিচয় এবং মানব অভিজ্ঞতার কেন্দ্র। আমাদের দৈনন্দিন জীবন “অটোপাইলটে” কাটে, অথচ মস্তিষ্কের ভিতরে প্রতিটি সেকেন্ডে অব্যাহত জটিল প্রক্রিয়া চলতে থাকে। প্রতিটি নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, এই ১.৫ কেজি ওজনের অঙ্গটি বাস্তবেই জ্ঞানীয় ও শক্তিশালী সবচেয়ে জটিল “কম্পিউটার”, যার রহস্য এখনো প্রায় পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

সূত্র ও আরও পড়ার জন্য

1. হারকুলানো-হোজেল, এস. (২০০৯)। দ্য হিউম্যান ব্রেইন ইন নাম্বার্স: অ্যা লিনিয়ারলি স্কেল্ড-আপ প্রাইমেট ব্রেইন। Frontiers in Human Neuroscience।

2. রেইকলে, এম. ই., ও গুসনার্ড, ডি. এ. (২০০২)। অ্যাপ্রেইজিং দ্য ব্রেইন’স এনার্জি বাজেট। Proceedings of the National Academy of Sciences।

3. জাই, এল., et al. (২০১৩)। স্লিপ ড্রাইভস মেটাবোলাইট ক্লিয়ারেন্স ফ্রম দ্য অ্যাডাল্ট ব্রেইন। Science।

4. National Institute of Neurological Disorders and Stroke (NINDS) – Concussion Information।

5. Society for Neuroscience (SFN) – Brain Facts Publications।

জাফর আহমদ

bn_BDBengali